করোনা সংকটে আর্শিবাদের নাম রংপুর করোনা হাসপাতাল

করোনা সংকটে আর্শিবাদের নাম রংপুর করোনা হাসপাতাল
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল।

মেরিনা লাভলী ♦ এক বছরপূর্তি হলো রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের। রংপুর বিভাগের করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল ১’শ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। যাত্রার শুরু থেকে জীবন ঝুঁকি নিয়ে সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা। সেবা দিতে গিয়ে অনেক নার্স আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়।

এক বছরের যাত্রায় এ হাসপাতালের অর্জনও কম নয়। চিকিৎসক-নার্সদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে সুস্থ্য হয়েছেন শত বছর ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধসহ প্রায় এক হাজার জন। করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এ হাসপাতালে। 
চিকিৎসক নব-দম্পতি এ হাসপাতালে শুরু করেছেন তাদের নতুন জীবন। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসায় বিভাগীয় জেলায় এ হাসপাতালের কার্যক্রম চালু হওয়ার কারণে চিকিৎসা নিয়ে স্বস্তি¡ পেয়েছেন রংপুর বিভাগের পৌনে ২ কোটি মানুষ।  
রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রংপুর বিভাগে করোনা আক্রান্ত রোগীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজে পিসিআর যন্ত্র স্থাপন করা হয়। এতে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয়। তবে করোনা রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল না থাকায় চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। 
রোগীদের বাড়িতে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা জেলাগুলোর জেনারেল হাসপাতালে বিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা দেয়া হতো। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনাররা অভিজ্ঞ না হওয়ায় তারাও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন। এ সময় আবশ্যক হয়ে পড়ে শুধুমাত্র করোনা রোগীদের জন্য একটি হাসপাতালের। স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তৎপরতা চালালে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল রংপুর নগরীর সদর হাসপাতাল সংলগ্ন ১’শ শয্যা বিশিষ্ট শিশু হাসপাতালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্প্রসারিত ১’শ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 
করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১০ শয্যার আইসিইউ সাপোর্ট, পুরুষ রোগীদের জন্য ৬০ শয্যা ও নারী রোগীদের জন্য ৩০ শয্যার ব্যবস্থা রাখা হয় এ হাসপাতালে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সুবিধা, পর্যাপ্ত ঔষধের ব্যবস্থা, ইনফেকশন প্রিভেনশনের ব্যবস্থা, লাশবাহী গাড়ি, করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহের জন্য টেকনোলজিস্টের ব্যবস্থা করা হয় এ হাসপাতালে। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগীদের টেলিমেডিসিন সেবা ব্যবস্থা রাখা হয় এ হাসপাতালে। 
এক বছরে করোনা হাসপাতালের কার্যক্রম : ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে শনিবার পর্যন্ত রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৪৮ জন। এর মধ্যে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯৯২ জন ও মারা গেছেন ১০১ জন। বর্তমানে ৪৭ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া ২২ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। 

৯০ বছরের বৃদ্ধের করোনা জয় : করোনাজয় করলেন ৯০ বছরের বৃদ্ধ গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার আব্দুল আজিজ আকন্দ। রংপুরের ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল থেকে ২ জুলাই দুপুরে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। ২৩ জুন সংকটাপন্ন অবস্থায় করোনা হাসপাতালে ভর্তি হন আকন্দ। তাকে সুস্থ্য করা ছিল এ হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে সুস্থ্য হতে থাকেন আকন্দ। ২ জুলাই হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়কসহ অন্যান্য চিকিৎসকরা তাকে ফুল ও চিঠি দিয়ে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান।
হাসপাতালে যাদের ঘর-সংসার শুরু : করোনা মহামারীর ভীতিকর পরিস্থিতিতে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে করোনা যুদ্ধে নাম লিখিয়েছেন এক চিকিৎসক নব-দম্পতি। দিনাজপুরের বাসিন্দা ডা. রিফাত মাহমুদ সরকার ও রাজশাহীর বাসিন্দা ডা. নূর-ই-জান্নাত সাবা আশা দু’জনই রংপুর মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। করোনা হাসপাতালের যাত্রার শুরু থেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন ডাঃ রিফাত। ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর পারিবারিকভাবে রিফাত ও আশার বিয়ে হয়। এরপর দু’জনের ঘর-সংসার শুরু হয় রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে। এমনকি বিয়ের পর প্রথম ঈদটিও উদ্যাপন করেন করোনা হাসপাতালে রোগীদের সাথে। বিয়ের পর জীবন ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের সেবা দিতে কোন আক্ষেপ নেই তাদের।  


এ ব্যাপারে ডাঃ রিফাত বলেন, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা-মা আমাকে সব সময় সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও আমার স্ত্রী ও আশপাশের সবার সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণার ফলেই সেবা দিয়ে যেতে পারছি। ডাঃ আশা বলেন, চিকিৎসকদের প্রধান লক্ষ্যই মানুষের সেবা দেয়া। চিকিৎসকদের সবসময় প্রস্তুত থাকা উচিত মানুষের সেবায়। একটা ক্রান্তিকালে সম্মুখযোদ্ধা হতে পেরে আমি ধন্য। আমাদের সেবায় যখন কেউ সুস্থ হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন সেটাই আমাদের প্রাপ্তি।
মাস্কের ফিতা দিয়ে বাঁধা হয় নবজাতকের নাভী : গাইবান্ধা পৌর এলাকার ব্রিজ রোডের নজরুল হক মঞ্জুর ছেলে মাহমুদুল হক সিয়ামের সঙ্গে ২০১৩ সালে বিয়ে হয় একই পৌরসভার পশ্চিমপাড়া মহল্লার মৃত সামসুল আলমের মেয়ে আজমেরী বেগম আশার। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর গাইবান্ধা শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের (সিজার) মাধ্যমে প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হয় আজমেরি বেগমের। স্বভাবতই দ্বিতীয় সন্তানেরও জন্ম হওয়ার কথা ছিল সেভাবেই। সব ঠিক থাকলে হয়ত সেটাই হত। ৩৬ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা আশা ৩০ আগস্ট করোনা পজেটিভ হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আশাকে। ২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। কিন্তু করোনা হাসপাতালে ডেলিভারীর করানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন চিকিৎসক ও নার্সরা। হাসপাতালের তত্ত্ববধায়কের নির্দেশে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স আসলে ট্রলিতে করে আশাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিলে তার ব্যাথা আরও বাড়তে থাকে এবং নবজাতকের মাথা সামনের দিকে চলে আসে। ডিউটি ডাক্তার ও সহকর্মী নার্সদের সহযোগিতায় বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই রোগীর নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। জন্ম হয় ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গর্ভফুল বের হয় এবং নবজাতকের নাভি কাটা হয় হাতের কাছে থাকা মেডিসিন কাটার সিজার দিয়ে। তারপর নাভি বাঁধা হয় হাতে থাকা সার্জিক্যাল মাস্কের ফিতা দিয়ে। মেয়ের নাম রাখা হয় সিদরাতুল মুনতাহা। ৫ সেপ্টেম্বর হাসি মুখে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে যান আশা ও তার নবজাতক সন্তান। 
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের এক বছরের কার্যক্রম নিয়ে হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক এসএম নূরুন্নবী বলেন, আমি নিজে থেকে করোনা হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ হয়নি, তবে করোনা যুদ্ধের একজন যোদ্ধা হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। করোনা হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীরাই চিকিৎসা নিতে আসে। আমরা আমাদের সাধ্যমত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এ মহামারী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাবো।